মানুষের জ্ঞানের প্রধান অন্তরায় হলো- তার ভুলে যাবার প্রবণতা। তাই সভ্যতার শুরুর দিকে মানুষ তথ্য সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এসময় মানুষ পাথরে কালি দিয়ে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন এঁকে রাখত। পরবর্তী সময়ে মানুষ দেয়াল, পাহারের গায়ে খোদাই করে তথ্য সংরক্ষন শুরু করে। সেই থেকেই তথ্য সংরক্ষনের যাত্রা শুরু। এই সকল পদ্ধতির প্রমাণ দেখা যায় প্রাচীন চীন, মিশরীয় সভ্যতায়। এরপর মানুষ তার প্রয়োজনে আবিষ্কার করে পাতায় লিখে তথ্য সংরক্ষনের পদ্ধতি।
বেশি দিন আগের কথা নয়। যখন তথ্য সংরক্ষনে মানুষ সম্পূর্ণ রূপে নির্ভরশীল ছিল কাগজের উপর। তবে প্রযুক্তি কল্যানময় আধুনিকায়নে পাল্টে যাচ্ছে এই কাগজ কলমের ধারনাও। তথ্য সংরক্ষনের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারা মূলত কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকেই শুরু হয়। আর বর্তমানে মানুষ কাগজের পরিবর্তে জোর দিচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষনে। আর এভাবেই হয়তো তথ্য সংরক্ষনের পদ্ধতিতে আসবে পরিবর্তন। ‘যেখানে অফিস হয়ে যাবে সম্পূর্ণ রূপেই পেপার ফ্রি’ অর্থাৎ তথ্য সংরক্ষনে প্রয়োজন হবে না কোন কাগজের।
তথ্য সংরক্ষনের এমন আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ে ভ‚মিকা রাখছে ‘ডেভনেট লিমিটেড’ নামের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে অ্যাবি, অ্যাটিজ, এভিশন এবং কোডাক সহ বিশ্বের খ্যাতনামা ৭টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদি ফাইল সংরক্ষণের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে নিজস্ব তথ্য সংরক্ষন ও ইডিএমএস সফটওয়্যার ‘ডকুডেক্স’।
বর্তমান সময়ে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে নথি সংরক্ষনের গুরুত্ব এবং সেক্ষেত্রে সেবার দিক নিয়ে কথা বলেছেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিডিবিএল ভবনে অবস্থিত ডেভনেট লিমিটেড এর পরিচালক এ.কে সাব্বির মাহবুব।
বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনায় ডেভনেটের ভ‚মিকাই প্রথম উল্লেখ করে সাব্বির মাহবুব বলেন, ‘সামনের সময়ে পেপার অফিসের জন্য নথি ব্যবস্থাপনা ও প্রসেস অটোমেশন সবচেয়ে উপযোগী পদ্ধতি হবে। তবে বাংলাদেশে ডেভনেটই প্রথম অটোমেটেড নথি ব্যবস্থা পদ্ধতি চালু করে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি ১৬.৬৭ রিম কাগজ প্রস্তুতের জন্য ১টি গাছ কাটা হয়। তাই প্রযুক্তি আমাদের স্পষ্ট ইশারা দিয়ে জানান দিচ্ছে এখন সময় এসেছে তথ্য সংরক্ষনের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি প্রণয়নের।
এই প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে দেশের সরকারি- বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের বিগত বছরের সংরক্ষিত তথ্য ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ে সেবা প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে ও পাবলিক গ্রন্থাগার সংরক্ষিত সকল বই, পেপার এবং তথ্যকে আমরা ডিজিটাল আর্কাইভ করে দিয়েছি। এসময় প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ১২ লক্ষাধিক পৃষ্ঠা পুরনো সংবাদপত্রের (স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ) আর্কাইভিং সম্পন্ন করা হয়েছে। যেখানে স্ক্যান করে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার নাম, বছর, মাস, দিন ইত্যাদি তথ্যাদিসহ ইন্ডেক্সিং করে তা ‘ডকুডেক্স আর্কাইভ’- এ সংরক্ষণ করা হয়েছে।’
এর ফলে বর্তমানে যেকোন সময় গ্রন্থাগারের এই বই এবং সংবাদপত্রের পুরণো সংখ্যাগুলো মুহূর্তেই খুজে পাওয়া সম্ভব। ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিপিডিটি, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্টাটিসটিকস (বিবিএস), এলজিইডি, স্বাস্থ্য অধিদফতর, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (ইআরসি), ইলেকশন কমিশন, এনটিআরসিএ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রাজউকের বিভিন্ন এলাকার প্লট এবং ফ্লাটের প্রায় শতাব্দী প্রাচীন নথিপত্র সংরক্ষিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে রাজউক থেকে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকদের এখন প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তি অনেক সহজতর হয়েছে। ডেভনেটের প্রযুক্তি ও সেবা ব্যবহার করে ব্যানবেইস তাদের ডকুমেন্টেশন সেন্টারের প্রায় পাঁচ শতাধিক পুস্তককে ‘ই-বুকে’র আওতায় নিয়ে এসেছে।
বেসরকারি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলালিংক, ব্র্যাক, আড়ং, কলেরা হাসপাতাল (আইসিডিডিআরবি), ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ওয়াইপো, সিটিসেল, এয়ারটেল, মানুষের জন্য-সহ রয়েছে প্রায় অর্ধশতেরও বেশি প্রতিষ্ঠান।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে আছে এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, লঙ্কা বাংলা ফাইন্যান্স ইত্যাদি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, কলেজ অব লেদার টেকনোলজি।
ব্যাংকিং সেক্টরে ডকুডেক্স ওয়ার্ক ফ্লো ব্যবহার করে এল. সি. এবং লোন প্রসেস পেপার লেস করা হয়েছে।
অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ডেভনেট নথি ব্যবস্থাপনায় ও সংরক্ষনে সহায়তা প্রদান করে থাকে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষনে ব্যবহারবান্ধব সফটওয়্যার ‘ডকুডেক্স’। এ প্রসঙ্গে সাব্বির মাহবুব জানান, ডিজিটাল এই সময়ে ব্যক্তিগত এবং অফিশিয়াল নথি সুরক্ষা নিয়ে সকলেই চিন্তিত। এসব তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ডেভনেট নিয়ে এসেছে ডিজিটাল আর্কাইভ প্রযুক্তি ‘ডকুডেক্স’। যেকোনো ধরনের ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে।
এছাড়াও তথ্য সংরক্ষনের নতুন আইসিআর (হাতের লেখা পড়তে সক্ষম এমন প্রযুক্তি) ব্যবস্থা নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যাবি কোম্পানীর একটি স্বয়ংক্রিয় ডাটা প্রসেস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই তথ্য সংরক্ষন করা যায়। যেখানে হাতে লেখা যেকোনো ফর্মের তথ্য স্ক্যানিং করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিকগনিশন, ভেরিফিকেশন ও ভেলিডেশন হয়ে ডাটা বেজে চলে যাবে। যার ইমেজ কপিও পৃথকভাবে সংরক্ষিত হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, আইসিআর পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষনে অন্য যেকোন ম্যানুয়ালভাবে তথ্য সংরক্ষনের চেয়ে অনেক কম সময় লাগে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সময় এবং অর্থ দুটোই কম খরচ হয়।
প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ এন্টারপ্রাইজ কন্টেন্ট ম্যানেজম্যান্ট সেবা প্রদান করে থাকি। আমরা স্বয়ংক্রিয় ডাটা প্রসেসিং, তথ্য ব্যবস্থাপনায় ‘ডকুডেক্স আর্কাইভ’, স্বয়ংক্রিয় ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া কার্যক্রমে ‘ডকুডেক্স ওয়ার্কফ্লো’ এবং কোডাক ও এভিশনের মতো বিশ্বে নাম করা প্রযুক্তি পণ্য ব্র্যান্ডের স্ক্যানার বিক্রি এবং সেবা প্রদান করে থাকি।’
প্রতিষ্ঠানটি এককালীন কিংবা বিভিন্ন প্যাকেজ আকারে এই সেবা প্রদান করে থাকে। এক নজরে ডেভনেট লিমিটেডের সেবা সমূহ:
এছাড়া আরও বিভিন্ন সেবা প্রদান করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরে তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে সাব্বির মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি বড় গার্মেন্টস রয়েছে। যারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। তবে তার সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা নেই বলে বছরে তার ক্ষতি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তবে তথ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।’
তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষনে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি ভাল সাড়া পেয়েছে। বছরটিতে ডেভনেট বেশ কয়েকটি ব্যাংক সহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্টানের ডাটা ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গে সাব্বির মাহবুব জানান, ‘২০১৫ সালে আমরা খুবই ভাল সাড়া পেয়েছি। বছরজুড়ে আমরা সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক (এসআইবিএল), আল- আরাফাহ্ ব্যাংক ইসলামি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক সহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের নথি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষনের কাজ করতেছি।’
এসকল প্রতিষ্ঠানের জন্য এলসি, ঋণ উত্তোলনের তথ্য এবং নতুন ব্যাংক একাউন্ট খোলার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সয়ংক্রিয়ভাবে ডাটাবেসে সংরক্ষনের কাজ করছে। এছাড়াও তথ্য সংরক্ষনের সাথে সম্পর্কীত নতুন জিনিস নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির একটি বড় অর্জনের মধ্যে রয়েছে ইডকলের সম্পূর্ণ পেপার ফ্রি অফিস ব্যবস্থাপনার কাজটি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, বিকাশের মতো ব্যাংকিং এবং আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকতর কাজ করা হয়েছে।
শুরু হওয়া নতুন বছর ২০১৬ কে কেন্দ্র করে নিজেদের বহুল জনপ্রিয় সফটওয়্যারের আপডেট সংস্করণ যুক্ত করতে যাচ্ছে প্রতিষ্টানটি। যেখানে সফটওয়্যারটি আরও ব্যবহারবান্ধব এবং অপশনগুলোকে সহজতর করা হচ্ছে। যাতে করে একজন সাধারন ব্যবহারকারী সফটওয়্যারটি সহজে ব্যবহার করতে পারে। যুক্ত করা হচ্ছে ‘গেমিফিকেশন’ ফিচার।
এই ফিচারটি ব্যবহারকারীকে কাজের মধ্যে বিনোদন দিতে সক্ষম হবে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ব্যবহারকারীর সাথে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণও করতে পারবে। যা ব্যবহারকারীর কাজের মনযোগ এবং একাগ্রতাকে তরান্বিত করবে।
প্রতিষ্ঠানের নতুন বছরের এ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডকুডেক্স সফটওয়্যারটিতে বেশ কিছু আপডেট নিয়ে আসতে যাচ্ছি। এজন্য একটি নতুন সংস্করণ অবমুক্ত করা হবে। যেখানে ‘গেমিফিকেশন’ নামের নতুন ফিচার থাকছে, যা ব্যবহারকারীকে কাজের মধ্যে বিনোদন দিবে। এছাড়াও নতুন বছরে নতুন সংস্করণের পাশাপাশি অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস স্মার্টফোনের জন্য ডকুডেক্স অ্যাপ অবমুক্ত করা হবে।’
এছাড়াও নতুন বছরে ডকুডেক্স সফটওয়্যারকে ক্লাউড ভিত্তিক করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। ফলে সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে ডিজিটাল তথ্যগুলো সরাসরি অনলাইন ক্লাউড স্টোরেজে সংরক্ষিত হয়ে যাবে।